লেখাঃ স্বাধীন আরিফীন।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে স্টেশনের কাছে আসতেই হাফিজের সাথে দেখা হয়ে গেলো। দূর থেকে দেখে প্রথমটায় তাকে চিনতে পারিনি। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছিল হাফিজ ই। তাই কাছে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে কিছুটা অবাক এবং অনেকটা হতাশ হলাম।
আমার অনুমান ভুল নয়। সেই লোকটা হাফিজই। তার পড়নে শুধুমাত্র একটা ময়লা লুঙ্গি। সে কিছুক্ষণ পরপর এই লুঙ্গি উরু পর্যন্ত উঠিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তার পাশে খুব বেশি না হলেও মোটামুটি একটা ভীর। মানুষের কৌতুহলী চোখ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এবং তাদের কেউ কেউ খুব সম্ভবত মনে মনে আশা করছে এই লুঙ্গি একসময় মাথায় উঠে যাবে। তারপর মজা ষোল কলা পূর্ণ হবে। হাফিজের শরীরের উপরের অংশে বেশিরভাগ জায়গায় কাটা ছেড়ার দাগ। কিছু দাগ পুরোনো বলে শুকিয়ে গেছে আর কিছু একদম টাটকা। দাগগুলো যে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট তা বুঝতে আমার একবিন্দু পরিশ্রম হলো না। এবং কেন যে তাকে এসব আঘাত শরীরে বহন করতে হয় তা আমার অজানা নয়।
হাফিজ আমার স্কুলের বন্ধু। ঠিক বন্ধু বলতে যা বুঝায় তাই। আমরা দুজন একসাথে স্কুল পালিয়েছি। বিকেল বেলা সবাই যখন ফুটবল মাঠে ফুটবলের উপর লাথি বসায় তখন আমি আর হাফিজ ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনেছি। ক্লাসের এক কোনে বসে লতিফার হঠাৎ শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছি এবং মুচকি হেসেছি।
স্কুলে হাফিজের থেকে ভালো বন্ধু আমার ছিলনা। কেউই আমার বন্ধু হতে চাইত না। প্রথমত স্যারদের ভাষায় আমার মাথায় গোবর পোরা ছিল বলে, আর দ্বিতীয়ত আমি কোনোদিন পরিষ্কার কাপর পরে স্কুলে যাইনি বলে। কিন্তু হাফিজ না চাইতেই আমার বন্ধু হলো। স্কুল জীবনের প্রথম প্রথম টিফিন টাইমে আমি যখন মন খারাপ করে মাঠের একপাশে চুপচাপ বসে থাকতাম তখন সে কোনো কোনোদিন একটা আইসক্রিম অথবা একটা বিস্কুটের পেকেট নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জোর গলায় বলত, "নে খা।"
সেই গলায় যে কতটা অধিকার মাখানো ছিল তা আমি বুঝতাম। তাই কোনো প্রকার দ্বিরুক্তি না করেই আমি আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে চুষতাম। এভাবেই আস্তে আস্তে আমরা দুজন বন্ধু হয়ে উঠি।
হাফিজের মাথা ভালো ছিলো। অন্তত স্যারেরা তাই বলত। কিন্তু তার পড়াশোনায় মনোযোগ ছিলনা। স্কুল পালানো তার প্রিয় কাজগুলোর একটি ছিল। কিন্তু যেদিন শত চেষ্টা করেও স্কুল পালাতে পারত না সেদিন টিফিনের পর ধীরেন্দ্রনাথ স্যারের অংক ক্লাসে পুরোটা সময় কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমি অবশ্য সবসময়ই তাকে সঙ্গ দিতাম। আমি তার পাশে দাড়িয়ে থাকতাম বলেই নাকি তার এতোখানি সময়কে কেবল এইটুকু মনে হতো। একনাগাড়ে চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর বসতে বসতে যখন সে এই কথাগুলো বলতো তখন আমি শুধুই হাসতাম। সেই হাসিতে উপেক্ষা ছিলো না, ছিলো ভালোবাসা এবং সহমত। আমারও যে তেমনই উপলব্ধি ছিলো তাই প্রকাশ করতাম ঐভাবে হেসে।
এত কাছের বন্ধুকে হঠাৎ করে কেন দেখতে হয় তা নিয়ে আমার উপর অভিযোগ উঠতে পারে। কিন্তু তার আগে আমাকে পুরোটা শুনানোর সুযোগ এবং সময় দিতে হবে।
আমাদের বন্ধুত্ব যখন এভাবেই এগুতে থাকে তখন একদিন শুনতে পেলাম হাফিজকে তার বাবা কি এক কারনে ঘরে আটকে রেখেছে। আমি খবর পেয়েই তার বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম যা শুনেছি তাই সত্যি। হাফিজের বাড়ির প্রায় সবাইকেই কারন জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, হাফিজ নাকি পাগল হয়ে গেছে। প্রথমে আমি একেবারেই বিশ্বাস করিনি। গতকালও তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। তার আচরনে কোনো প্রকার সন্দেহ হয়নি। তাই আমার পক্ষে এই কথা বিশ্বাস করা কিছুটা কঠিনই ছিল। কিন্তু একটু পরেই যখন হাফিজের ঘর থেকে অশ্রাব্য ভাষায় হাফিজের গালাগালি ভেসে এলো তখন আর বিশ্বাস না করে উপায় ছিলো না। হাফিজদের বংশে পূ্র্বেও এরকম রোগ ছিলো। এবং আমি যতদূর জানি এটা একধরনের বংশগতীয় ব্যাপার।
এর পর থেকে হাফিজের বাড়িতে আমি প্রায়ই যেতাম কিন্তু তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেতাম না। শুধু জানালা দিয়ে তাকে দেখতাম। সে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। কোনো কথা বলত না। আমি একসময় চোখ মুছতে মুছতে চলে আসতাম। পরদিন আবার স্কুল ছুটি হতেই তার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম।
কিন্তু আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে আমার উৎসাহ কমতে লাগল। একসময় বাবার সাথে শহরে এসে পড়লাম। তারপর অনেকদিন কেটে গেলো। আমার গোবর পোরা মস্তিষ্ক নিয়ে একটা ছোটখাট চাকরি জোগাড় করে ফেললাম। বিয়েসাদী করে ঘর সংসারে মন দিলাম। এদিকে হাফিজের কথা একবারও মনে পড়লো না।
আজ হঠাৎ তাই তাকে দেখে একপ্রকার চমকেই গিয়েছিলাম। হাফিজকে দেখে মনে হচ্ছে এখনো তার মাথায় সমস্যা আছে। তাই আমি একপ্রকার নিশ্চিত যে সে আমাকে চিনতে পারবে না। তাই তাকে ডাকব কি-না সেটাই ভাবছিলাম। যখন ডাকা ঠিক হবে না ভেবে মন খারাপ নিয়ে ফিরে আসছিলাম তখন পেছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল, "আরিফ।"
আমি চমকে পিছনে তাকালাম। হাফিজ আমাকে চিনতে পেরেছে। মুখভর্তি হাসি নিয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। তারপর আশেপাশের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, "এই যে আমার বন্ধু। আমার বন্ধু।"
তার মুখে বন্ধু শব্দটি শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি লাগল। আমি চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আশেপাশের সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই অর্ধনগ্ন লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, "কেমন আছিস তুই?"
তখন আমার মাথায় এটা ছিল না যে, একটা পাগলকে এভাবে রাস্তায় জরিয়ে ধরলে মানুষ আমাকেও পাগল বলবে। আমি শুধু মাথায় রেখেছিলাম, আমরা বন্ধু।
পৃথিবীর কোনো বন্ধুত্ব নষ্ট না হোক।